সিএস জরিপের ইতিহাস
সিএস জরিপের পূর্ণরূপ হলো **ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে** (Cadastral Survey), যা জমির সঠিক পরিমাপ, সীমানা নির্ধারণ এবং ভূমি রেকর্ড তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত ভূমি মালিকানা, কর সংগ্রহ এবং ভূমি বিরোধ নিরসনের জন্য একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। সিএস জরিপের ইতিহাস মূলত ব্রিটিশ ভারতে ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনের সাথে যুক্ত, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাব ফেলে। এখানে সিএস জরিপের ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
### ১. **ব্রিটিশ শাসনামলে সিএস জরিপের সূচনা**
- **ব্রিটিশ শাসনের প্রাথমিক সময় (১৭৬৫-১৮৫৭)**: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানি (রাজস্ব আদায়) পাওয়ার পর ভূমির ওপর ভিত্তি করে রাজস্ব সংগ্রহের প্রয়োজন হয়। জমির সঠিক পরিমাপ, মালিকানা নির্ধারণ, এবং ভূমির কর আদায়ের জন্য ভূমি জরিপের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এ সময় জমির পরিমাপ ও রাজস্ব আদায়ে স্থানীয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো।
- **১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত**: লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (Permanent Settlement) ফলে ভূমি জরিপের গুরুত্ব বেড়ে যায়। কর নির্ধারণের জন্য জমির সঠিক পরিমাপ ও মালিকানা নিশ্চিত করতে জরিপ করা প্রয়োজন ছিল। এই জরিপে ভূমির আকার ও ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হতো।
### ২. **ক্যাডাস্ট্রাল জরিপের সূচনা (১৮৫০-এর দশক)**
- **১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজের অধীনে**: ভারতের বিদ্রোহের পরে ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ রাজ ভারতে শাসন শুরু করে, এবং ভূমি ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব সংগ্রহ আরও সংগঠিত ও নিয়মিত করার জন্য ভূমি জরিপের প্রক্রিয়াকে আরও পদ্ধতিগতভাবে চালু করে। এর ফলে সিএস বা ক্যাডাস্ট্রাল জরিপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
- **১৮৬০-এর দশকে ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ**: ১৮৬০-এর দশকে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জমি জরিপ এবং রেকর্ড সঠিকভাবে সংরক্ষণের জন্য ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে চালু করে। এর লক্ষ্য ছিল প্রতিটি জমির সীমানা, পরিমাণ, মালিকানা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা।
### ৩. **সিএস জরিপের বৈশিষ্ট্য**
- **ভূমি সীমানা নির্ধারণ**: ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভের মাধ্যমে প্রতিটি জমির সঠিক সীমানা নির্ধারণ করা হয় এবং প্রতিটি জমির পৃথক একটি রেকর্ড তৈরি করা হয়।
- **ম্যাপিং এবং রেকর্ড সংরক্ষণ**: প্রতিটি জমির মানচিত্র (ম্যাপ) তৈরি করা হয়, যা জমির অবস্থান এবং সীমানার নির্ভুল চিত্র প্রদান করে। এই মানচিত্রগুলিকে কেসিএস ম্যাপ বলা হয়।
- **মালিকানার নথি প্রণয়ন**: জমির মালিকানা সংক্রান্ত সঠিক নথিপত্র তৈরি করা হয়। এতে জমির মালিক, জমির ধরন, পরিমাণ, এবং কোনো কর বা ঋণের তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে।
### ৪. **বাংলাদেশে সিএস জরিপ**
- **বাংলাদেশের জন্মের পূর্বে**: বাংলাদেশে সিএস জরিপ ব্রিটিশ শাসনামলে শুরু হয়। পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমির পরিমাপ ও সীমানা নির্ধারণের জন্য সিএস জরিপ পরিচালিত হয়েছিল।
- **স্বাধীনতার পরে**: স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে সিএস জরিপের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। জমি নিয়ে বিরোধ সমাধান, ভূমি কর, এবং উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জমির সঠিক রেকর্ড ও মানচিত্রের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে এখনো সিএস জরিপের তথ্য ভূমি বিরোধ নিরসনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
### ৫. **সিএস জরিপের সীমাবদ্ধতা ও পরবর্তীকালের সংশোধন**
- **আরএস জরিপ**: সিএস জরিপের অনেক ভুল এবং অস্পষ্টতা থাকার কারণে ১৯৬০-এর দশকে **আরএস (রিভিশনাল সেটেলমেন্ট) জরিপ** চালু করা হয়, যা সিএস জরিপের ভুলত্রুটি সংশোধন এবং নতুন মালিকানার তথ্য অন্তর্ভুক্ত করে।
- **বিএস জরিপ**: বাংলাদেশে বর্তমানে **বিএস (বাংগালাদেশ সেটেলমেন্ট) জরিপ** চালু হয়েছে, যা সিএস ও আরএস জরিপের চেয়ে আরও আধুনিক এবং সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণ করতে সক্ষম।
### ৬. **ডিজিটালাইজেশন**
- **আধুনিককালে**: বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক এবং স্বচ্ছ করার জন্য সিএস জরিপসহ অন্যান্য ভূমি জরিপের তথ্য ডিজিটালাইজ করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় জমির মালিকানা এবং সীমানা সংক্রান্ত তথ্য অনলাইনে রাখা হয়, যা ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং বিরোধ মীমাংসায় সহায়ক।
সিএস জরিপের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, এটি ভূমি মালিকানা, কর সংগ্রহ, এবং জমির ব্যবহার সংক্রান্ত সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন