নতুন ভূমি আইনে সমস্যা কোথায়
**ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩** (Land Crime Prevention and Remedy Act 2023) প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ, যেমন জালিয়াতি, জবরদখল, ভুয়া দলিল প্রস্তুত ইত্যাদি বন্ধ করা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত প্রতিকার দেওয়া। তবে এই আইনের কিছু দিক নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে, যা কার্যকর বাস্তবায়ন এবং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। নিচে আইনটির প্রধান সমালোচনাগুলো তুলে ধরা হলো:
### ১. **ব্যবস্হাপনাগত দুর্বলতা**
আইনটি অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী হতে পারে না কারণ সরকারি ভূমি ব্যবস্থাপনায় এখনও দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক জটিলতা ব্যাপক। কর্মকর্তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত আচরণ, বিশেষ করে ভূমি রেকর্ডিং এবং দলিল সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলোতে, আইনের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এ আইন প্রয়োগের যথাযথ প্রস্তুতি না থাকলে সঠিকভাবে প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
### ২. **প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা**
আইনটি প্রণয়ন করা হলেও, স্থানীয় পর্যায়ে এর প্রয়োগে বাধা আছে। অনেক সময় স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী আইনকে পাশ কাটিয়ে জবরদখল বা জালিয়াতি করতে সক্ষম হয়। ফলে আইন প্রয়োগকারীরা অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ উপযুক্ত সুরক্ষা পান না।
### ৩. **অপরাধ প্রমাণের জটিলতা**
ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ প্রমাণ করা জটিল। দলিল বা কাগজপত্রে জালিয়াতির মামলা প্রায়ই প্রমাণ করতে দীর্ঘ সময় লাগে, যা আইনের উদ্দেশ্য ব্যাহত করে। বিশেষ করে ভূমি জালিয়াতির ক্ষেত্রে প্রমাণের ভার ক্ষতিগ্রস্তের উপর পড়ে, যা অনেক সময় সাধারণ মানুষের জন্য অসম্ভব হয়ে ওঠে।
### ৪. **ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর প্রভাব**
অনেক সময় ভূমি আইন কঠোর হওয়ায় ক্ষুদ্র কৃষক বা দরিদ্র জনগোষ্ঠী এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্ষুদ্র কৃষকরা প্রায়ই তাদের জমি সঠিকভাবে নিবন্ধন করতে পারেন না বা ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হন না, ফলে তারা আইনের ফাঁদে পড়তে পারেন।
### ৫. **দীর্ঘমেয়াদি ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি**
আইনের আওতায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্দেশ্য থাকলেও, বর্তমানে ভূমি সংক্রান্ত মামলাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে। এই আইনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ সমাধান পাওয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না।
### ৬. **ডিজিটালাইজেশন না হওয়া**
আইনে ভূমি সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিরোধে ডিজিটাল পদ্ধতির কথা উল্লেখ থাকলেও, বাস্তবে ভূমি প্রশাসনের ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া খুব ধীর। অনেক সময় ভূমিকেন্দ্রিক তথ্য ও দলিলপত্র এখনও ম্যানুয়াল ব্যবস্থার অধীনে থাকে, যা জালিয়াতির সুযোগ তৈরি করে।
### ৭. **স্থানীয় প্রভাব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ**
অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো আইনের প্রয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সঠিকভাবে আইনের সুরক্ষা পেতে ব্যর্থ হন।
### ৮. **সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব**
আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। ফলে তারা জানেই না কিভাবে আইনি প্রতিকার চাইতে হয় বা কোন পরিস্থিতিতে তারা আইনের সুরক্ষা পেতে পারেন।
**উপসংহার:**
ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত প্রশাসনিক কর্মী, এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই আইনের কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব। অন্যথায়, এটি কেবলমাত্র আইনি কাঠামোর একটি অংশ হিসেবে রয়ে যাবে, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন