আরএস জরিপের ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্য
**আরএস জরিপের (RS Survey)** পূর্ণরূপ হলো **রিভিশনাল সেটেলমেন্ট সার্ভে**। এটি ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (CS Survey) এর পরবর্তী উন্নত সংস্করণ, যা জমির সঠিক পরিমাপ, মালিকানা এবং সীমানা নির্ধারণের জন্য পরিচালিত হয়। আরএস জরিপের ইতিহাস মূলত জমির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়কালে বাস্তবায়িত হয়েছে।
### আরএস জরিপের ইতিহাস
#### ১. **ব্রিটিশ শাসনামল**
- **সিএস জরিপের সূচনা (১৯ শতক)**: ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার গ্রহণের পর, পুরো ভারতবর্ষে জমি ব্যবস্থাপনা ও কর আদায়ের জন্য প্রথম ব্যাপক আকারে জমির সীমানা নির্ধারণ এবং রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়, যা **ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (CS)** নামে পরিচিত। সিএস জরিপের মাধ্যমে প্রতিটি জমির মালিকানা, সীমানা, এবং পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছিল। এটি ছিল উপমহাদেশের প্রথম বৃহৎ ভূমি জরিপ কার্যক্রম।
- **আরএস জরিপের প্রয়োজনীয়তা**: সিএস জরিপের পর জমির সীমানা, মালিকানা এবং ব্যবহার নিয়ে অনেক পরিবর্তন আসে। সিএস জরিপের সময় অনেক ভুল বা ত্রুটি ছিল, যেমন জমির সঠিক পরিমাপ, মালিকানার পরিবর্তন না থাকা, এবং সীমানা নিয়ে অস্পষ্টতা। তাই সিএস জরিপের পর সংশোধন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এ কারণেই ১৯ শতকের শেষের দিকে এবং ২০ শতকের শুরুতে **রিভিশনাল সেটেলমেন্ট সার্ভে (আরএস জরিপ)** চালু করা হয়।
#### ২. **আরএস জরিপের সূচনা (১৯৩০-এর দশক)**
- **প্রথম আরএস জরিপ**: ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথমবারের মতো আরএস জরিপ পরিচালিত হয়। এর মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ববর্তী সিএস জরিপের ভুল সংশোধন করা এবং জমির নতুন মালিকানা ও সীমানা নির্ধারণ করা। এটি বিশেষ করে জমির বিরোধ এবং বিভক্তি নিরসনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়।
- **জমির পুনঃবন্টন ও খতিয়ান হালনাগাদ**: সিএস জরিপের সময় জমির মালিকানা এবং সীমানার যে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল, তা আরএস জরিপের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়। জমির মালিকানা পরিবর্তন, নতুন জমির রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত করা এবং জমির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়।
#### ৩. **পাকিস্তান শাসনামলে আরএস জরিপ**
- **পাকিস্তান পিরিয়ড (১৯৪৭-১৯৭১)**: পাকিস্তান শাসনামলে (বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে) ব্রিটিশ শাসনের পর জমির মালিকানা, সীমানা এবং কর ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা বাড়তে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) জমির খতিয়ান হালনাগাদ ও সীমানা নির্ধারণের জন্য বেশ কয়েকটি আরএস জরিপ পরিচালিত হয়। এই সময়েও সিএস জরিপের ত্রুটি সংশোধন করা হয় এবং নতুন ভূমি মালিকদের অন্তর্ভুক্তি ঘটে।
#### ৪. **বাংলাদেশে আরএস জরিপের বাস্তবায়ন**
- **স্বাধীনতার পর**: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভূমি ব্যবস্থাপনা উন্নত করার লক্ষ্যে আরএস জরিপের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। পূর্বে পরিচালিত সিএস জরিপ এবং পাকিস্তান আমলের রেকর্ডে যেসব ত্রুটি ছিল, তা ঠিক করতে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আরএস জরিপ পরিচালনা করা হয়।
- **আরএস জরিপের কার্যক্রম**: বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা সঠিক করার জন্য, ১৯৭০-৮০ এর দশকে সরকার আরএস জরিপ পরিচালনা শুরু করে। জমির সঠিক পরিমাপ, মালিকানা এবং সীমানা নিয়ে যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল, তা সমাধানের জন্য আরএস জরিপের মাধ্যমে নতুনভাবে রেকর্ড করা হয়। জমির খতিয়ান হালনাগাদ, জমির ব্যবহার পরিবর্তন এবং সীমানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে আরএস জরিপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
#### ৫. **আধুনিক যুগে আরএস জরিপের প্রয়োজনীয়তা**
- **ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা**: বর্তমানে বাংলাদেশে ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ এবং ডিজিটালাইজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে সিএস ও আরএস জরিপের তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যা সহজে অনুসন্ধান এবং যাচাই করতে সাহায্য করছে।
- **ভূমি বিরোধ সমাধান**: জমির সঠিক রেকর্ড এবং মালিকানা নির্ধারণের জন্য আরএস জরিপের রেকর্ড এখনও ভূমি বিরোধ সমাধানে প্রাথমিক দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
### সারসংক্ষেপে
**আরএস জরিপের ইতিহাস** ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি মূলত সিএস জরিপের ভুল ও ত্রুটি সংশোধনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল, এবং এর মাধ্যমে জমির মালিকানা, সীমানা, এবং ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য হালনাগাদ করা হয়। জমির সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণ, বিরোধ নিষ্পত্তি, এবং কর নির্ধারণে আরএস জরিপ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন